স্বাধীনতা হাঁপিয়ে ওঠে রাস্তায় / সঞ্জয় কুমার মুখোপাধ্যায়
—‘সকাল বিকেল এখন সবার নিত্য একই গল্প’ এই ভাবে এসে
গেলো এবারের স্বাধীনতা।
—‘রাস্তাতে চোখ গেলেই কষ্টার্জিত স্বাধীনতা এখন দুই হাত
তুলে হাঁপ ছাড়ছে। ’
চারিদিকে লোকজন ভীত শঙ্কিত করোনা আবহাওয়া চলছে... ট্রেন সব বন্ধ,
গুটি কয়েক বাস চলছে, বিদিশাকে অগত্যা হাসপাতাল যেতে হবে বাসে। সদ্য উচ্চমাধ্যমিক
পাশে করে স্নাতকোত্তর পড়ছে বিদিশা, তার এক বিরাট এক দুঃসময় দিয়ে চলছে, তার মা
করনায় আক্রান্ত তাই রোজ যেতে হচ্ছে হাসপাতালে প্রায় দশদিন হয়ে গেল। বাসেই যায় রোজ,
পিতৃহারা বিদিশার সঙ্গী বলতে কেবল কলেজের বন্ধু অনির্বাণ, সে রোজ তার নিজের বাড়িতে
ঝামেলা করে তবু বিদিশার সাথে যাবে বলে আসে। এদিকে বাস কম, তাই খুব ভিড় সব সিট ফুল... তাই সোজা
হয়ে দাঁড়াতে বিদিশা অনির্বাণের কাঁধ ধরে আছে... মাঝে মাঝে ঝাঁকুনিতে শত চেষ্টা করে
একে অপরের ওপর হেলে পরছে। এরমধ্যে কোনরকমে একটা সিট খালি হতেই বিদিশা অনির্বাণকে বসতে
বলতেই অনির্বাণ বলল-“ তুই বস না...। ” বিদিশা বলল- “ বস না...তুই ” বলে জোর করে
হাত ধরে বসিয়ে দিলো ।
পাশের এক বসা মধ্যবয়স্ক প্রবীণ ভদ্রলোক একটু বিরক্তি নিয়ে
আড় চোখে দেখে নিল। তার কাছে এই দুঃসময় ওদের এইটুকু স্বাধীনতা লোকটির কাছে অশালীনতায় রূপান্তর হয়ে
গেছে, তাই কিছু না জেনে বুঝে, লোকটির মনের ভিতর একটা আগ্নেয়গিরির ফুটন্ত লাভা উদ্গার হতে শুরু করছে। কিন্তু তবে কিছু বলবার আগেই বাস শিয়ালদহ
এসে পৌছতেই মুহূর্তের মধ্যেই বাস খালি হয়ে গেল লোকটি বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে নেমে
গেলো সাথে সাথে বিদিশা আর অনির্বাণ নেমে গেলো।এটা ওদের কাছে আজকাল রোজকার ব্যাপার তাই ওদের অভিব্যাক্তি থাকে না।
বিদিশা তার মাকে দেখে ফেরবার পথে আবার হাসপাতাল থেকে দুজনে বের হল, এটাই
তাদের এখন রোজকার গল্পও। রোজ ওরা দুজনে যাওয়ার পথে দুজন দুজনে দেখে বিদায় জানায়,
পরস্পরের চোখ পড়ে নেয়, আসলে বিদিশা অনির্বাণের চোখের ভাষা জানে, মনের গোপন কথা
বুঝতে পারে। ওরা এখনও নিজেরা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় নি, তবু এক মুহূর্তে ওদের এই
পাশাপাশি থাকা আজকের এই পরাধীন জীবনে অনেকটা মানে রাখে, যা ওই বাসের লোকটি বুঝবে
না, ওদের চাওয়া পাওয়া জীবনের না সুখ পাবার ব্যাকুলতা দুজনকে আঁকড়ে জাপটে ধরে।
তাই ওরা দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে আর
ঠিক সেই মুহূর্তে ফেরার বাসটি ওদের ফেলে বেরিয়ে যায়। একটা
বাস স্ট্যান্ডে আশেপাশে লোকজন বাসে উঠবার সময় একজন ভদ্রলোক কিছু না জেনেই সকালের
লোকটির মতন ট্যারা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেই ফেললো—‘এদের এখনও রাস্তায় বেরিয়ে মজা করা চাই !’
আসলে এই মানুসগুলো মনের পরাধীনতাকে ভালবেসে ফেলেছে , সেটা বিদিশা ও
অনির্বাণ বুঝতে পারবে না কোনদিন, যেমনটি লোকটি ওদের ভালবাসার স্বাধীনতা বুঝতে
অক্ষম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন