
কোভিড-১৯ মহামারী হয়তো আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে নতুন পথ দেখাবে
- সঞ্জয় কুমার মুখোপাধ্যায়'
বর্তমান অবস্থায় করোনা মহামারী সারাবিশ্বে যেভাবে তার ধ্বংসাত্মক ভূমিকা নিয়েছে তাতে সকলের মন এখন নানা ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়ে দোদুল্যমান, প্রতিনিয়ত এক একটা অলিখিত ভয় ক্রমাগত মানুষকে একটা অনিশ্চয়তার দিকে প্রভাবিত করে চলেছে। মানুষকে সরকার শৃংখলাবদ্ধ হয়ে বন্দী জীবনযাপন এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে বাধ্য করলেও বেশ কিছু ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তা তাদের মনকে নিমগ্ন করে রেখেছে ।
চিন দেশের উহান প্রদেশে প্রথম এই ভাইরাসটির সংক্রমণ দেখা যায়। তারপর এখন অবধি ২৯ টি প্রজাতির বা টাইপের এই করোনা ভাইরাস দেখ গিয়েছে। এর প্রতিষেধক নিয়ে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা কাজ করে চলেছেন।ভারতবর্ষের ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ, কাউন্সিল অফ সাইন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ,এছাড়া ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন, ইন্ডিয়ান স্পেশ রিসার্চ অর্গানাইজেশন ইতিমধ্যে তাদের কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলায় মিশন ঠিক করে নিয়েছে ।স্বল্প মূল্যের ভেন্টিলেটর বানানো থেকে জিন সিকয়েন্সিং এবং স্যানিটাইজার এবং পিপিই উৎপাদনে বিশেষ ভুমিকা নিয়েছে। ভারতে মূলত দুটি টাইপের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে দেখা গেছে, তাই এই লকডাউন এর সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে এবং তাতে মানুষের নিজেকে পৃথক করে রাখার প্রবণতা সমসাময়িক ভাবে বেশ কিছুটা সুফল এনেছে এটা ঠিক। সেটা কিন্তু জনসংখ্যার নিরিখে কোভিড-১৯ আক্রমণের তথ্যসূচী দেখলে বোঝা যাবে যে বিশ্বের নিরিখে আমারা কিছুতা স্বস্তির জায়গায় বর্তমানে থাকলেও সেটা খুব যে ভবিষ্যতে আশাবাঞ্জক সেটা এখনি বলা যাবে না।কারণ উপজুক্ত টেস্ট এখন কর হয় নি। করোনা ভাইরাসের ধ্বংসাত্মক ব্যাধি চারিদিকে যাতে খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রেখে যে বিভিন্ন সরকারি নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, জনসাধারণের এখন একমাত্র কাজ সেদিকে যথাযথভাবে পালন করা। বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা গেছে সচেতন মানুষরা সেটা পালন করলেও একটা বহুল অংশের জনসংখ্যা এটির দিনের পরদিন বিরোধিতা করে চলেছে । প্রশ্ন হল কেন এই নির্দেশ গুরুত্বপূর্ণ ? আইসোলেশন গেলে কি সুফল পায়া যাবে ? সত্যি আমারা কি করোনা মুক্ত ভারত দেখতে পাবো ?
বিভিন্ন রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসন এই ব্যাপারটিতে সচেষ্ট হলেও মূলত কিছু আরো কার্যকরী সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজনীয়তা হয়ে পড়েছিল যেটি হয়তো কেন্দ্র ও রাজ্যের দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎ বা কিছু শ্রেণির মানুষের কথা ভেবে নেওয়া হয়ে ওঠেনি। একটু ভেবে দেখলে বোঝা যাবে যে আজকের দিনে সেনাবাহিনী নামানো বা ১৪৪ ধারা করে পুরো ব্যাপারটা আটকানো কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল ?
আসলে লকডাঊনের সফলতা মূলত টেস্ট করবার অপর নির্ভরশীল সেটা বুঝতে হবে। অধিকাংশ ভারতবাসীর বসবাস মূলত গ্রাম কেন্দ্রিক সেখানে কমবেশি শহরগুলোতে শহরের প্রশাসন ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে কিন্তু অসচেতনতা বা বিরোধিতা প্রত্যক্ষভাবে সবার চোখে এসে যায় কারণ শহরাঞ্চলে ডিজিটাল মিডিয়া বা সংবাদ মাধ্যমের ব্যাপকতা ,সে দিক দিয়ে গ্রামের চিত্রটা অনেকটাই অন্যরকম, সেখানে প্রশাসন এখন শহরাঞ্চলের মতন দ্রুত সংবাদ কালেকশন করবার পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারে নি । তবু এই বিপদের মাঝেও দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে দেশও মানুষকে বাঁচাবার লক্ষ্যে সবাই রাজ্যগুলিতে সরকার কাজ করে চললেও, ত্রাণ বণ্টনে দেখা গেছে বিভিন্ন দলের প্রতীক চিহ্নের ব্যবহার চলেছে, মিডিয়ার প্রচারকে কাজে লাগানো হচ্ছে । ভারতের জনসংখ্যা একটা বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী, বাকি অনেকটা অংশ কিছুটা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার এবং অসংগঠিত শ্রমিক শ্রেণী । এই বৈশাখ মাসে বেশ কিছু মানুষ যারা কেবলমাত্র শুধু এই নতুন বছরের ৩-৪ মাস অপেক্ষায় বসে থাকেন সারা বছরের উপার্জন করতে, তাদের অবস্থার দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন ছিল।যেমন সরাসরি কিছু টাকা এদের হাতে বণ্টনের ব্যবস্থা করা। বিদেশের অনেক দেশেই তাদের নাগরিকদের হাতে সরাসরি টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে, ভারতে সে রকম কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বা চেষ্টা করা হয় নি।এখন অবধি যা কিছু সাহায্য এখা দেখে তা এসেছে মূলত সরকারের গণবন্টন ব্যবস্থা, বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা (এনজিও),এছাড়া কিছু বিত্তশালী কর্পোরেট সংস্থা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে। সরকারের দেওয়া ত্রাণ বিভিন্ন অঞ্চলে জেলা তথা অঞ্চল ভিত্তিক প্রতিনিধির মাধ্যমে করা হয়েছে যেটির মধ্যে সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়েছে । ডিজিটাল মিডিয়ার দৌলতে এখন খবরকে খুব সহজেই চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তার ওপর বিভিন্ন দলের আইটি সেল বিভিন্ন প্রচার সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।আগামী দিনের নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে যেটির মধ্যে দিয়ে নানা ভুল তথ্য এবং রাজনৈতিক ভূল চিন্তার বার্তা সাধারণ মানুষকে দেওয়া হচ্ছে ।এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের উচিত এইসব উড়ো খবরে প্রচারে নিজেদের চিন্তা ব্যাহত না করে সরকারের বিভিন্ন নির্দেশগুলির পালন করা এবং করোনা কে প্রতিহত করার জন্য বিভিন্ন চিকিৎসকদের দেওয়া উপদেশ বা নির্দেশাবলী গুলোকে যথাযথ পালন করা।
এটা সত্যিই দৈনন্দিন জীবনের কর্মব্যস্ততা এবং গতানুগতিক জীবনধারায় মানুষ এত বেশি প্রবাহিত হয়ে গেছে যে এই বদ্ধ জীবন তাদের কাছে এক অসহনীয় হয়ে চলেছে, কিন্তু এটা বুঝতে হবে প্রবাদবাক্য “আপনি বাঁচলে বাপের নাম” আজ কতোটা প্রয়োজনীয়। এঈ সংক্রমণ ব্যাধি মৃত্যুর হার কম ( বর্তমানে ভারতে ৩% ) হলেও এর সংক্রমণের প্রবণতা অনেকাংশে বেশি ভারতবর্ষের মতো একটি জনবহুল দেশে । আজকেও ৭৪ বছর পরেও আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিকাঠামো সেই জায়গায় গড়ে ওঠেনি এটা প্রতিদিন আমরা বূঝতে পারছি, এমনকি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সমস্ত রাজ্যে তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেটা যেমন সত্যি, তেমন এটাও ঠিকই যে চিকিৎসক এবং রোগীদের অনুপাত এখনও বড়ই কম (প্রতি দশ হাজার রোগীর রক্ষণাবেক্ষণে চিকিৎসক একজন) যেটি অতিমাত্রায় কম, তাই বিপদের সম্ভাবনা অবশ্যম্ভাবী যদি না বিকল্প এই লকডাউন ব্যবস্থা চলতে দেওয়া না হয় । করোনা ভাইরাসের এই মহামারী আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে চিকিৎসাশাস্ত্রে ভারতবর্ষে উন্নত চিকিৎসা পরিকাঠামোর পরিকল্পনা এবং চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয়তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ । তাই সরকার এখন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছেন যে আগামী কুড়ি-একুশ সালের মধ্যে এর চিকিৎসার ব্যাপক উন্নতি সাধনে সরকার পদক্ষেপ নেবে যার জন্য টাকা সেই খাতে খরচের জন্য রাখা হয়েছে এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় ১৭,২৮৭ কোটি টাকা বিভিন্ন রাজ্যের পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং বিভিন্ন চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ করেছে ।তবে এই পুরো পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সঠিকভাবে পরিলক্ষিত করার কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের মতো দেশে ।
এবার আসি ভবিষ্যৎ অর্থনীতির কথায় কোভিড-১৯ মহামারী দ্বারা সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে ভারতের জন্য তাত্ক্ষণিক অগ্রাধিকারগুলি কী কী ? জীবন বাঁচান, স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধি করুন এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় রোধ করুন।এই সমস্তগুলির জন্য একটি বিশাল তহবিলের ইনজেকশন প্রয়োজন। এখনও অবধি অর্থনৈতিক প্যাকেজ আকারে জিডিপির ০.৭৫ % ( ১,৭০,০০০ কোটি ) টাকা ঘোষণা করা হয়েছে। এটি যা প্রয়োজন তা থেকে অনেক দূরে - সংকট কাটানোর জন্য ভারতীয় অর্থনীতির ৫ লক্ষ কোটি রুপি সমর্থন ও উদ্দীপনা প্রয়োজন। যদিও এটি চোখের জল যোগানের মতো মনে হলেও এটি সম্পূর্ণ সম্ভব কীভাবে ?
প্রথমত, ব্যয় যেখানেই সম্ভব সেখানে কাটাও। এর মধ্যে কেন্দ্রের স্থাপনা ব্যয় (৬,০৯,০০০ কোটি টাকা) ২৫% কমানো, প্রতিরক্ষা ব্যয় (৩,২৩,০০০) ২০% কমিয়ে দেওয়া,কিছু সময়ের জন্য পেনশনের ব্যয় (২,১০,০০০) ১০% কমিয়ে দেওয়া, বুলেট ট্রেন প্রকল্পটি বাতিল করা এবং তাক লাগানো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে র্যাফেল চুক্তি অনুযায়ী সেখানে বাকি র্যাফেল বিমান সরবরাহে আপতত স্থগিত করা ,সংসদ ভবন, ইন্ডিয়া গেট এবং সেন্ট্রাল ভিস্তা অঞ্চল পুনর্নির্মাণ বিষয়গুলো বন্ধ রাখা ।
আমেরিকার করোনার প্যাকেজটি তার জিডিপির ১০ %। ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত অন্যান্য দেশগুলি ভারতের চেয়ে অনেক বেশি বরাদ্দ করেছে। আমরা ব্যয় করতে এত কৃপণ কেন ? করোনার আগুন নেভাতে যদি হয় তবে এখন যদি ব্যয় সঙ্কোচন না করি, আমরা কখন করব ?
তবে এরপর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় হবে বাজারে টাকার প্রবাহ বা জগান ঠিক রাখা সেটা যাতে সমান বণ্টন হয় নিম্ন মাঝারি ব্যবসায়ে ও শিল্পে উৎসাহ প্রদানের মাধমে তাই আর বি আই ৫০০ কোটি টাকার সংস্থান এবং রিপো রেট কমিয়ে লিকুইডিটি বাড়ানোর পদক্ষেপ অবশ্যই ভারতের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির পক্ষে সহায়ক হবে তবে বাজেটে ব্যয় সঙ্কোচন আগামী দিনে জিডিপি বাড়ার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নেবে।